'আজ ভোরে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। শুনেছি ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় ,কিন্তূ এতদিনে এটাও বুঝে গেছি এসব মিথ্যে ,সংস্কার।' এই পর্য্যন্ত লিখে চুপ করে বসে ছিলেন মীরা দেবী। আচ্ছা কুসংস্কার জেনেও কি নিজে সত্যি কিছু আশা করেন না ?ভাবেন না এই বুঝি সে এসে কাঁধে হাত রাখল। এই বুঝি তার ভোরের স্বপ্ন সত্যি হলো। কলম রেখে ক্লান্ত শরীর টা হেলিয়ে দিলেন চেয়ার এর পিছন দিকে।
রাশি রাশি ভাবনা তাঁকে আবার বিমনা করে দিল। এই পাঁচ
বছরে অন্তত বিশ ত্রিশ বার স্বপ্ন নয় সত্যি অনুভব করেছেন তাঁর স্পর্শ। একথা কেউ বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু এটা সত্যি। তিনি অবশ্য কাউকে বোঝাবার চেষ্টাও করেন নি।এটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। তবে লিখতেই বা বসেছেন কেন?জানেন না তিনি ,বোঝেন নাও ঠিক। তবে লিখলে বোধ হয় একটু মনের ভার বোধ কমে।
আজকের স্বপ্ন টা অবশ্য স্বপ্নই। নিছকই স্বপ্ন। তবু কেমন যেন মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না। সারা দিনের কাজের ফাঁকে বারবার স্বপ্নটা উঁকি দিয়েযাচ্ছে। সরাতে পারছেন না কিছুতেই। এটাই কি ডেসটিনি। কি জানি হবে হয়ত.অনেক কিছুইতো মেনে নিয়েছেন। মানতে বাধ্য হয়েছেন।নীরবে দিনের পর দিন রাতের পর রাত চোখের জলে ভেসেছেন। এখন বুঝেছেন ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের নিজেদের সংসার। তাদের সামনে অভিমানে চোখে জল এসে গেলে তাদের মনে হয় ,এটা মায়ের দুঃখ বিলাসিতা। আর একথা যখন বেশ জোর গলাতেই বলে তখন কষ্টটা আরো দ্বিগুন হয়ে যায়।
ওরা ভাবে দামী কাপড় জামা ,জুতো ,ভালো খাওয়া দাওয়া বেড়াতে নিয়ে যাওয়া কিছুতেই কি মায়ের মন ওঠেনা ?নারে ,সত্যিই ওঠেনা। এসব কিছুই চাইনি কখনও। অবশ্য এসব ওদের জানার কথাও নয়। ওদের কি কষ্টের আঁচ পেতে দিয়েছেন মীরা দেবী ?হ্যা তিনি, তিনিই সব সামলেছিলেন একা হাতে দুর্যোগের দিন গুলোতে। কষ্ট ছিল ,চিন্তা ছিল ভাবনা ছিল ,তবুও শান্তি ছিল মনে...স্বামী স্ত্রী তে কত ঝগড়া ছিল ,হাসিকান্না ছিল খুনসুটি ছিল ,মান অভিমান সবই ছিল। সবচেয়ে মূল্যবান যা ছিল তা হলো পরস্পরের প্রতি ভরসা, ভালবাসা ,বিশ্বাস,নির্ভরতা
একটু বেশি ই তাঁর স্বামী তাঁর ওপর নির্ভর করতেন। মানুষটা নিপাট সরল সাদাসিধে মানুষ ছিলেন।বিদ্বান গুণী মানুষেরা যেমন হয় আর কি। শুধু বুকভরা ভালবাসা ছিল সবার প্রতি। কিন্তু কোনো পারিবারিক সমস্যায় পরলে বা কোনো কুটুম্বিতে রাখতে হলে বাচ্ছাদের মত মুখ কাঁচুমাঁচু করে কাছে এসে দাঁড়াত। কারো অসুস্থতা বা কষ্ট সহ্য করতে পারতনা। তাই ,বাড়ির সবার জন্য হাসপাতাল ,ডাক্তারখানা সবই সামলাতে হয়েছে মীরা দেবী কে।
যেদিন তিনি তার লেখাপড়ার জগত ছেড়ে সব প্রিয়জনদের ছেড়ে ,মেয়েদের ছেড়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন,সেদিন জানতে পেরেছিলাম কত জনের ভরসা ছিলেন উনি। ভাবলে কষ্টের মধ্যেও গর্বে নিজের মন ভরে ওঠে যে ওই মানুষটা আমার কাছে স্বামীর পোশাক ছেড়ে বেশির ভাগ সময়টাই শিশুর সারল্যে কাটিয়েছেন আমার আঁচল ছায়ায়।
হঠাত একটা মিষ্টি গন্ধ আর হাওয়া এসে টেবিলের কাগজ গুলো ছড়িয়ে গেল চারদিকে।চিন্তার জাল কেটে মীরা দেবী উঠে বসলেন সোজা হয়ে। দৃঢ়তার সঙ্গে। কাগজ গুলো সযত্নে রেখে দিয়ে সোজাসুজি তাকালেন টেবিলে রাখা ওনার ছবিটার দিকে বলা ভালো তাঁর দিকে। আর বললেন এই ভাবেই তুমি আমার সব দুঃস্বপ্ন বারবার দূর করে দিও। যতদিন কাছে টেনে না নিতে পারো অন্তত কাছে থেকো ,সাথে থেকো আগলে রেখো। ...
মীরা দেবীর আজ আর লেখা হলনা। ........